শুরুতেই নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি করতে হবে। হজের প্রতিটি আনুষ্ঠানিকতা শ্রমসাধ্য ব্যাপার, এ ব্যাপারে সম্যক ধারণা থাকতে হবে। হজে যাওয়ার আগে কিছু প্রস্তুতি নেওয়া ভালো। যেমন,
প্রতিদিন কমপক্ষে আধা ঘণ্টা হাঁটার অভ্যাস করুন। এতে হজে যাওয়ার পর কষ্ট কম অনুভব করবেন।
ডায়াবেটিস–সংক্রান্ত অন্যান্য জটিলতা থাকলে হজযাত্রার আগেই ডায়াবেটিস চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
হজে যাওয়ার কমপক্ষে ১০ দিন আগে মেনিনজাইটিস টিকা ও ফ্লু ভ্যাকসিন নিতে হবে।
চিকিৎসকের কাছ থেকে পরিপূর্ণ ব্যবস্থাপত্র বা প্রেসক্রিপশন নিয়ে নিতে হবে। জরুরি অবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকা করে নিতে হবে। (কমপক্ষে ৪৫ দিনের ওষুধ)।
ডায়রিয়া, বমি, সর্দি, কাশি, জ্বর ইত্যাদি হলে করণীয় সম্পর্কে চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিক, প্যারাসিটামল ও ওআরএসের মতো ওষুধ সঙ্গে নিতে হবে। একটি ভালো গ্লুকোমিটার, স্ট্রিপ, লেনসেট ও অ্যালকোহল সোয়াব সঙ্গে নিতে হবে।
ইনসুলিন ব্যবহার করলে ইনসুলিন ভায়াল, পেন, সিরিঞ্জ ও নিডল সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। ইনসুলিন সংরক্ষণের উপযোগী ফ্লাস্ক বা ঠান্ডা ওয়ালেট সঙ্গে নেবেন। মূল লাগেজে রাখলে ইনসুলিন নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সে জন্য হাতের লাগেজে ইনসুলিন রাখুন। হোটেলে এটি ফ্রিজে রাখুন। মিনা, মুজদালিফা ও আরাফাতে ফ্রিজে রাখার ব্যবস্থা নেই, সে জন্য ওই কদিনের জন্য আলাদাভাবে প্রয়োজনমতো ইনসুলিন নিয়ে যাবেন।
হাইপোগ্লাইসেমিয়া চিকিৎসার জন্য গ্লুকোজের ট্যাবলেট বা ড্রিংকস, চকলেট, জেল বা জেলি, জুস, খেজুর, মিষ্টি বিস্কুট বা কেক সব সময় সঙ্গে রাখতে হবে। খাবার খেতে বা পেতে দেরি হতে পারে, তাই বিকল্প কিছু খাবার ও পানীয় সঙ্গে রাখুন।
আরামদায়ক ও সঠিক মাপের জুতা সঙ্গে নিতে হবে। সাদা ছাতা সঙ্গে নিতে ভুলবেন না। চশমা ব্যবহার করলে অবশ্যই প্লাস্টিকের তৈরি অতিরিক্ত একজোড়া চশমা সঙ্গে নেবেন।
হজ ক্যাম্পে আগেই জানিয়ে রাখুন আপনি একজন ডায়াবেটিসের রোগী। প্রয়োজনে হজ ক্যাম্পের চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
১. হাইপারগ্লাইসেমিয়া: অনেক সময় মুখে খাওয়ার ওষুধ, ইনসুলিন ঠিকমতো ব্যবহার না করলে; বেশি খাওয়াদাওয়া করলে রক্তের সুগার বেড়ে যেতে পারে। ঘন ঘন প্রস্রাব ও পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। গ্লুকোজ মনিটরিং ও স্ট্রিপ দিয়ে কিটোন বডি টেস্ট করতে হবে। ইনসুলিন ও ওষুধের মাত্রা ঠিক রাখতে হবে। মিষ্টিজাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে।
২. হাইপোগ্লাইসেমিয়া: শারীরিক ক্রিয়াকলাপ বেড়ে যাওয়া ও খাবারের নিয়ম মেনে চলতে না পারার কারণে সুগার কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। সব সময় কিছু খাবার যেমন গ্লুকোজ, চিনি, বিস্কুট খেজুর সঙ্গে রাখতে হবে। মাঝেমধ্যে গ্লুকোমিটার দিয়ে সুগার টেস্ট করতে হবে। ইনসুলিন ও মুখে খাওয়ার ওষুধের পরিমাণ ২৫ শতাংশ কমিয়ে নিতে হবে। হজকালীন সময়ে অ্যানালগ ইনসুলিন ব্যবহার করলে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি কমে। নিয়মিত খাবারের পাশাপাশি দুই খাবারের মধ্যবর্তী সময়ে স্ন্যাক্স খেতে হবে। অনিয়মিত খাবারের ক্ষেত্রে রোগীরা বাদাম, ফল এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য গ্রহণ করতে পারেন। তাওয়াফের আগে প্রয়োজনে জটিল কার্বোহাইড্রেট এবং খেজুর খাওয়া যেতে পারে। হজযাত্রার সময় কঠোরভাবে সুগার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা উচিত নয়; কারণ, এ সময় হাইপোগ্লাইসেমিয়াই গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে। যেমন শরীরে ঘাম, বুক ধড়ফড়, মাথা ঝিমঝিম দেখা দিলে গ্লুকোজ, খেজুর, বিস্কুট ইত্যাদি খেয়ে ফেলুন। ১৫ মিনিট পর পুনরায় সুগার টেস্ট করুন। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
৩. পানিশূন্যতা: অতিরিক্ত গরম ও ঘামে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। প্রতিদিন অন্তত দুই থেকে তিন লিটার পানি পান করতে হবে। জমজমের পানি উত্তম। অ্যাজমা রোগীর ঠান্ডা পানি না খাওয়াই ভালো।
৪. পায়ে ক্ষত বা প্রদাহ: সব সময় নরম ও আরামদায়ক জুতা ব্যবহার করুন। তাওয়াফ ও সায়ী করার সময় নরম মোজা পরিধান করুন। ভিড়ের মধ্যে পা সাবধানে রাখুন। অজু ও গোসলের পর পা শুকনা রাখুন। প্রতিদিন দুইবার ময়েশ্চারাইজিং লোশন পায়ে লাগান। রাত্রে শোয়ার সময় পা পর্যবেক্ষণ করুন। ফোসকা বা ঘা দেখা দিলে প্রোফাইল্যাকটিক অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করুন। ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
৫. হিটস্ট্রোক: রোদ এড়িয়ে চলুন, রোদে সাদা ছাতা ব্যবহার করুন। অতিরিক্ত অসুস্থতা বা গরম বোধ করলে-সাদা কাপড়/ইহরামের কাপড় ভিজিয়ে গায়ে দিন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে থাকুন। পানি ও ফলের রস বেশি পান করুন। সব শরীর ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে বাতাস করতে হবে। প্রয়োজনে নিকটস্থ মেডিকেল সেন্টারে নিতে হবে।
৬. ইনফেকশন: মাস্ক পরিধান করুন, সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার রাখুন। খাওয়ার আগে হাত পরিষ্কার রাখুন। বিশুদ্ধ খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। ডায়রিয়া হলে ওরস্যালাইন পরিমাণমতো পান করুন।
শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি, চিকিৎসকের পরামর্শ ও কঠোর অনুশীলন মেনে চললে একজন ডায়াবেটিসের রোগীর পক্ষেও সুষ্ঠু ও নিরাপদ হজ পালন সম্ভব।
ডা. এ কে এম মূসা , অধ্যাপক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, আলোক হেলথ কেয়ার, মিরপুর ১০, ঢাকা