সরকারের কাছে পুলিশের একগুচ্ছ দাবি, কমছে

সরকারের কাছে পুলিশের একগুচ্ছ দাবি, কমছে

ঢাকা: স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন, ঝুঁকিভাতা, ছুটি, প্রমোশন, স্বামী-স্ত্রীকে একই কর্মস্থলে পদায়নসহ একগুচ্ছ দাবি তুলে ধরেছেন পুলিশ সদস্যরা। কিছু দাবি মানার আশ্বাসও পেয়েছে তারা। এসেছে ভিআইপি প্রটোকল কমানো ও পুলিশে লাল গালিচা সংবর্ধনা বাতিলের মতো সিদ্ধান্ত। পুলিশ সপ্তাহে অংশ নেওয়া একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে এসব তথ্য জানা যায়। এবারের পুলিশ সপ্তাহ-২০২৫ প্রতিপাদ্যে ‘আমার পুলিশ, আমার দেশ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ’।

মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) পুলিশ সপ্তাহের প্রথম দিনে উদ্বোধন ও পদক প্রদান অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এসব দাবি তুলে ধরেন পুলিশ সদস্যরা।

পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ সুপার মো. আল আসাদ প্রধান উপদেষ্টার কাছে দাবি করেন, পুলিশ কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় কাজ করতে চায় না। এক্ষেত্রে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন জরুরি।

ছুটি ও প্রণোদনার দাবি তুলে ধরেন ঢাকা জেলার কনস্টেবল সামিয়া স্বর্ণা বলেন, অন্যান্য বিভাগের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বছরে সব মিলিয়ে প্রায় ১২৯ দিন ছুটি ভোগ করেন। কাজের ধরন ও চাপের কারণে পুলিশ সদস্যরা কখনও এ ছুটি ভোগ করতে পারেন না। তাই এ সময় কর্মকাল হওয়ায় পুলিশ সদস্যদের কমপক্ষে ৩০ দিন বা এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ আর্থিক ক্ষতিপূরণ ভাতা দেওয়া হোক।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পুলিশ সদস্যের উদ্দেশে বলেন, আপনাদের কাছ থেকে কিছু প্রাথমিক বক্তব্য শুনলাম। শুনে বুঝতে পারলাম যে অনেকগুলো কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। যেটা আমাদের পক্ষ থেকে করার কথা ছিল, তা হয়নি। এর আগে আমরা একবার নিজেদের মধ্যে বসেছিলাম। আমার কাছে খুবই খারাপ লাগছিল। কী রকম পরিস্থিতিতে আপনাদের কাজ করতে হয়, তা আমার জানা ছিল না। আপনাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন কত কঠিন, সেটার মাত্রা কত গভীর।

ড. ইউনূস বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে আমরা কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আশা করি তা বাস্তবায়িত হয়েছে। কতদূর হয়েছে, সেটা আবার খোঁজ নেবো। আমরা আজকে আবার বসবো যাতে করে আপনাদের কাজের সহায়ক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যায়। আপনারা যেন কাজে উৎসাহ পান এবং পরিস্থিতি সহায়ক হয়।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রধান উপদেষ্টা ধৈর্যসহকারে পুলিশের দাবি-দাওয়াগুলো শোনেন এবং তিনি দাবিগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের আশ্বাস প্রদান করেন।

এরপর দুপুরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তারাদের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে পুলিশ সদ্যরা আরও বেশ কয়েকটি জরুরি দাবি তুলে ধরেন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তারা জানান, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে বেশ কিছু দাবি তুলে ধরে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। এরমধ্যে কনস্টেবল থেকে আইজিপি পর্যন্ত ঝুঁকি ভাতা চালু করা, থানা ও ফাঁড়িগুলোতে আবাসন সমস্যার সমাধান করা, ট্রেনিং একাডেমিতে ভাতা চালু করা, নারী প্রশিক্ষণ সেন্টার বৃদ্ধি করা, পুলিশ সদস্যদের পোস্টিং (স্বামী/স্ত্রী একই কর্মস্থলে পদায়ন), এএসপি পদে নিয়োগ বিধি সংশোধন, সরকারিভাবে ট্রাফিক বক্স স্থাপন এবং নারী ট্রাফিকের জন্য নারীবান্ধব টয়লেট ফ্যাসিলিটিজ, বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালের মান উন্নয়ন, পুলিশের বাজেট দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ার প্রস্তাব, ফোর্স বৃদ্ধি করে কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা, একই পদে দীর্ঘদিন চাকরি করার পর অবসরের আগে পদোন্নতি দেওয়া (কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পর্যন্ত) -সহ একাধিক প্রস্তাব ছিল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে।

এসব দাবির প্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, সবগুলো দাবি যৌক্তিক। কনস্টেবল থেকে এসআইদের ঝুঁকি ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে উচ্চ সীমা (সিলিং) বন্ধ করার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে নিচের স্তরের পুলিশ কর্মকর্তারা আগের চেয়ে অধিক হারে ঝুঁকি ভাতা পাবেন। পুলিশ সদস্যদের মোটরসাইকেল কেনার জন্য ঋণ প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে পুলিশের এসআই ও এএসআইদেরকে এ ঋণ প্রদান করা হবে। সরকার যাতে ঋণের সুদের টাকা পরিশোধ করে-সে বিষয়েও অনুরোধ জানানো হবে।

তিনি বলেন, অধস্তন পুলিশ সদস্যদেরকে নিজেদের বৃহত্তর জেলার মধ্যে পদায়নের চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। একইভাবে স্বামী-স্ত্রী দুজনে পুলিশ সদস্য হলে তাদেরকে একই জেলায় পদায়নে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। পুলিশের জনবল সংকট রয়েছে। তাই তাদের সাংগঠনিক কাঠামোতে (টিওএন্ডই) জনবল বৃদ্ধি করা দরকার। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে তিনি আইজিপিকে নির্দেশ দেন।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময় উপস্থিত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ভিআইপি ও মন্ত্রীরা যাতায়াতে পুলিশের যে প্রটোকল দেওয়া হয় সেসব প্রটোকল কমিয়ে আনতে বলেছেন। এছাড়া পুলিশে লাল গালিচা সম্পূর্ণ বাতিল করতে বলেছেন তিনি।

এর আগে মঙ্গলবার সকালে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে বাংলাদেশ পুলিশ অডিটোরিয়ামে পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, গত আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে সে সময় এ দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল। পুলিশের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। সরকার পরিস্থিতি উন্নতির জন্য যা কিছু প্রয়োজন সব রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সড়ক মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা ও জনদুর্ভোগ নিরসন, বিশেষ অভিযান পরিচালনা অংশীজনদের সঙ্গে পুলিশের আন্তঃযোগাযোগ জোরদার করা, পুলিশ সদস্যদের মনোবলবৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে দেশের মানুষ পুলিশ বাহিনীকে খুবই শক্তিশালী ভূমিকায় দেখতে চায় বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। এ সময় তিনি নারী-শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ সংবেদনশীল হয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনে পুলিশ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

ড. ইউনূস বলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে দেশের ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচন যেন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয় সেজন্য পুলিশ সদস্যদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনে সব প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রতি সমান আচরণ, ভোটাররা যাতে নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে তাদের নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, সেই পরিবেশ নিশ্চিত করার সর্বোচ্চ দায়িত্ব আপনাদের ও আমাদের।

পুলিশ সদস্যদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পুলিশ বাহিনীর সদস্য হিসেবে বা তার চাইতে বড় বিষয় হচ্ছে এদেশের একজন নাগরিক হিসেবে ভবিষ্যতে কখনো যেন পুলিশ বাহিনীকে দলীয় বাহিনী হিসেবে বা অন্যায় কাজে ব্যবহার করা না যায়, যার জন্য একটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি।

নির্বাচনের আগের সময়টা অত্যন্ত কঠিন সময় উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আপনাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে, পরাজিত শক্তি যেন কোনোভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করতে না পারে।