Advertisement

‘দাগি’ আসলে কেমন সিনেমা

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল, ২০২৫

‘দাগি’ সিনেমায় আফরান নিশো। প্রযোজনা সংস্থার সৌজন্যে
‘দাগি’ সিনেমায় আফরান নিশো। প্রযোজনা সংস্থার সৌজন্যে

বেশ কয়েক বছর ধরে ঈদকে কেন্দ্র করে নির্মিত সিনেমাগুলো নিয়েই বেশি আলোচনা ও সমালোচনা দেখা যাচ্ছে, যা সত্যিই সিনেমাশিল্পের জন্য আশাব্যঞ্জক। এবারের ঈদে মুক্তি পাওয়া একদম সামাজিক ও পারিবারিক সিনেমা ‘দাগি’র নানা দিক নিয়ে আলোচনায় আসা যাক।
দাগি আসামির সাজা খাটার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাকেন্দ্রিক আত্মপীড়া, অনুকম্পা ও অনুশোচনাকে উপজীব্য করে সিনেমার কাহিনি। দীর্ঘদিন পরে দর্শকেরা এমন একটি সিনেমা দেখতে পাচ্ছে, যেটা পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখা যায়। ভরপুর গালাগাল ও অশ্লীল সংলাপ ব্যবহারের প্রবণতাকে বাদ দিয়ে স্বাভাবিক ভাষা ব্যবহারের জন্য এ সিনেমাটি ভবিষ্যতে অনেক নির্মাতাদের আলাদাভাবে পথ দেখাবে। দৈনন্দিন সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত ভাষা ও সব বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সংলাপের বিন্যাসে পরিচালক অনবদ্য মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। এই সিনেমায় অর্থপূর্ণ হিন্দু ও উর্দু শায়েরি যেভাবে যুক্ত করা হয়েছে, সেটা সম্ভবত আর কোনো বাংলা সিনেমায় আগে কখনো হয়েছে বলে মনে পড়ে না, যা সিনেমাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

এদিকে ‘দাগি’ সিনেমার চিত্রনাট্য বেশ অভিনব হয়েছে, যা নিছক প্রেম, কাল্পনিক কাহিনি, ভিলেন, কাটাকাটি ও মারামারির গল্প থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রায় পুরোপুরি বাস্তবধর্মী ও কল্পনাবিহীন এই সিনেমা নিশ্চিতভাবেই দর্শকদের আলাদাভাবে ভাবতে শেখাবে। মনস্তাত্ত্বিক ও ধীরগতির এমন ছায়াছবিতে অ্যাকশনধর্মী সিনেমার মতো টান টান উত্তেজনা বা ক্লাইম্যাক্স বা টুইস্ট না থাকলেও দর্শকের মনোজাগতিক ভাবনার যথেষ্ট খোরাক জোগাবে।

তবে ভারতীয় নিষিদ্ধ ফেনসিডিল ও সীমান্ত এলাকার চোরাকারবারিদের অপরাধজগতের অন্ধকার দিকের কিছু বিষয় এই সিনেমায় উঠে এলেও ফেনসিডিল ব্যবহারের ফলে সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্ম যে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে, সেটা এখানে দেখানো হয়নি। ফেনসিডিল ও অন্যান্য মাদকের কুফল ও পরিণতির বিষয়টি অল্প করে তুলে এনে আগামী প্রজন্মের কাছে মাদকবিরোধী বার্তাও পৌঁছে দিতে পারত।

গুজব বা মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে বর্তমানে আলোচিত মিডিয়া ট্রায়ালের বিষয়টি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই সিনেমায়, যা সত্যি শিক্ষণীয়। হরহামেশা আমরা অযাচিতভাবে বানানো, মিথ্যা তথ্যসংবলিত ভিডিও আপলোড করে মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে কতশত মানুষের জীবনকে যে বিপন্ন করে দিচ্ছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এই ‘দাগি’ সিনেমাটি প্রকারান্তরে বিভ্রান্তিমূলক মিডিয়া ট্রায়ালের বিরুদ্ধে একটা বিমূর্ত প্রতিবাদ। অতীতের কৃত ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসা অসহায় মানুষকে মানবিক হয়ে ভালোবাসার মাধ্যমেই কেবল সমাজের মূল স্রোতোধারায় নিয়ে আসার আবেদনই হলো এই সিনেমার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক। তা ছাড়া বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দ্রুত ধনী হওয়ার যে প্রবণতা রয়েছে, যা সত্যিকার অর্থেই বিপজ্জনক; এই সিনেমার মাধ্যমে সুচিন্তিতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

ইদানীং গল্পনির্ভর না হয়ে নায়ক–নায়িকানির্ভর সিনেমাগুলো থেকে নানাভাবেই ‘দাগি’ অনেকখানি ব্যতিক্রম। এই সিনেমার লোকেশন, পোশাক, সাজসজ্জা, চিত্রায়ণ, সংলাপসহ সিনেমাটোগ্রাফি এককথায় অপূর্ব ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে চিত্রগ্রহণের ফ্রেমিং ও লাইটিং অধিকতর ভালো হওয়ার সুযোগ ছিল এবং ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক চমৎকার হলেও ভিন্নভাবে প্রকাশের ক্ষেত্রে মুনশিয়ানা তেমন একটা ছিল না। তা ছাড়া এই সিনেমার কলাকুশলীরা সবাই মনে দাগ কাটার মতো অভিনয় করেছেন। এ সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র আফরান নিশো ‘সুড়ঙ্গ’–এর তুলনায় অনেক বেশি পরিপক্ব অভিনয় করেছেন। এদিকে প্রত্যেক কলাকুশলী পূর্ণমাত্রায় চরিত্রে ঢুকে তমা মির্জা, শহীদুজ্জামান সেলিম, গাজী রাকায়েত, সুনেরাহ বিনতে কামালসহ অন্যরা অনবদ্য অভিনয় করেছেন। তবে বাক্‌হীন তরুণী চরিত্রে অভিনয় করা সুনেরাহর চরিত্রটির পরিণতি সিনেমার শেষেও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তা ছাড়া অশ্লীলতা, অশালীন দৃশ্য ও তথাকথিত খোলামেলা আইটেম সং ছাড়া যে দর্শকের মনে দাগ কাটা সিনেমা নির্মাণ করা যায়, সেটার প্রমাণ হলো এই ‘দাগি’ সিনেমা। এ সিনেমার দৃশ্য ও ঘটনার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ সব কটি গানই বেশ চমৎকার, যা নিঃসন্দেহে দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। এ ক্ষেত্রে গানের গীতিকার ও সুরকার সম্পূর্ণভাবে সফল হয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়।

অধিকন্তু ‘দাগি’ সিনেমা নির্মাণের পরিচালক হিসেবে শিহাব শাহীনকে বেশ আত্মবিশ্বাসী ও পরিপক্বই মনে হয়েছে। অপর দিকে শুধু ঈদকেন্দ্রিক সিনেমা নির্মাণ না করে বছরের অন্য সময়েও ‘দাগি’র মতো অভিনব গল্পের আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা উপহারের প্রত্যাশা শিহাব শাহীনদের সব সময় তাড়িত করবে।

Lading . . .